কোষবিদ্যা ০১: কোষের প্রাথমিক আলোচনা
জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় কোষ। জীবদেহের গাঠনিক একক কোষ। জীব নিয়ে গবেষনা ও জ্ঞান লাভের জন্য কোষ সম্পর্কে জানতে হবে। কোষবিদ্যা সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবে আজকে কোষ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করা হবে।
কোষ বিজ্ঞান কাকে বলে?
কোষের গঠন ও কাজ নিয়ে কোষ বিজ্ঞান আলোচনা করে। এটা সত্য যে কোষ হল জীবের মৌলিক একক। পৃথিবীর সকল জীব কোষ দিয়ে গঠিত। কোনো জীব একটি কোষ, আবার কোনো জীব ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। কোষ বিজ্ঞানে জীব গঠনকারী এসকল কোষের সাধারণ গঠন থেকে শুরু করে জটিল ক্রিয়া ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
কোষ কী?
কোষ হলো জীবের মৌলিক একক এবং সজীব
· সকল জীব কোষ দিয়ে গঠিত। কোনো জীব একটি আবার কোনো জীব ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত
· সকল জীব গঠনের মূল একক হিসেবে বিবেচিত
· মানব দেহ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। এরা দেহ গঠন করে, খাদ্য থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে, এসকল পুষ্টিকে শক্তিতে রূপান্তর করে এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদন করে।
· কোষ জীবের বংশগতির উপাদান ধারণ করে এবং পরবর্তী প্রজন্মে তার রূপান্তর ঘটায়।
কোষের বৈশিষ্ট্য
- কোষের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
- এরা সকল জীবের মৌলিক গাঠনিক ব্লক। এককথায় কোষ একটার সাথ আরেকটা যুক্ত হয়ে জীব গঠিত হয়।
- · গাঠনিক দিক বিবেচনায় কোষ দুই প্রকার-আদি বা প্রোক্যারিওটিক কোষ (prokaryotic) ও উন্নত বা ইউক্যারিওটিক কোষ (eukaryotic)।প্রোক্যারিওটিক কোষ ইউক্যারিওটিক অপেক্ষ অধিক সরল। এদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো: প্রোক্যারিওটিক কোষে নিউক্লিয়াস নেই এবং তাদের ডিএনএ নিউক্লিয়ার মেমব্রেন দিয়ে আবৃত নয়।
- · তারা ডিএনএ রূপে জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণ করে
- তারা প্লাজমামেমব্রেন দিয়ে বাহ্যিক পরিবেশ থেকে পৃথক থাকে। একইসাথে এই মেমব্রেন দিয়ে বাহ্যিক পরিবেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।
- তারা রাইবোসোমের মাধ্যমে প্রোটিনের সংশ্লেষণ ঘটায়
- জলীয় মাধ্যমে নিমজ্জিত অসংখ্য অঙ্গাণু ধারণ করে
কোষ আবিষ্কার
কোষ আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অর্জন। এর মাধ্যমে আমরা জীব সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পার। পাশাপাশি জীব নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় এটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। কোষের গঠন ও কাজ জানার মাধ্যমে জীব সম্পর্কে আমরা নতুনভাবে জানতে পেরেছি। এবারের আলোচনায় আমরা কোষ আবিস্কারের ধারাবাহিক গল্প নিয়ে আলোচনা করব:-
· ১৬৬৫ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট হুক কোষ আবিষ্কার করেন। তিনি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে বোতলের কর্ক পর্যবেক্ষণ করে এক বিষ্ময়কর তথ্য উদঘাটন করেন। তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গঠন দেখতে পান যা দেখতে ছোট ছোট কক্ষের মতো। কাজেই তিনি এই ক্ষুদ্র কক্ষের মতো গঠনের নাম দেন ‘কোষ’। তার ব্যবহৃত যৌগিক অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা থাকায় তিনি কোষের গঠনের বিস্তারিত দেখতে পান নি। অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ভালোভাবে দৃশ্যমান না হওয়ায় কর্ক তার পর্যবেক্ষণের আলোকে কোষ জড় বস্তু বলে বিবেচনা করেন।
· এরপর অ্যান্থনি ভন লিউয়েন হুক অধিক বিবর্ধন ক্ষমতা সম্পন্ন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোষ পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়, তিনি কোষের মধ্যে চলমান কিছু উপাদান দেখতে পান। ফলে তিনি বলেন যে, অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দৃশ্যমান বস্তু (কোষ) সজীব।
· ১৮৮৩ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন সর্বপ্রথম কোষের গঠন অবলোকন করেন। এছাড়াও তিনি অর্কিডের কোষের নিউক্লিয়াস দেখতে পান।
কোষ তত্ত্ব
জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক তত্ত্ব হলো কোষ তত্ত্ব। এই তত্তানুসারে কোষ হলো সকল জীবিত টিস্যুর মৌলিক একক।
১৮৮৩ সালে জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী মাথিয়াস জ্যাকব শ্লেইডেন সর্বপ্রথম বলেন সকল উদ্ভিদের গাঠনিক ব্লক হলো কোষ।
একই বছরে, অন্য একজন জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী থিওডোর সোয়ান উল্লেখ করেন যে কোষ প্রাণীরও গাঠনিক একক। তাদের এই বক্তব্যে প্রাণী ও উদ্ভিদের গঠনে সামান্য পার্থক্য আছে এমন নির্দেশনার মাধ্যমে শেষ হয়।
তবে তাদের এই উদ্ভাবন ‘কোষ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠার বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কোষ তত্ত্ব অনুযায়ী কোষ হলো সকল জীবের গাঠনিক একক। তবে নতুন কোষ কিভাবে উৎপন্ন হয় তা কোষ তত্ত্ব ব্যাখা করে না। পরবর্তীতে ১৮৮৫ সালে জার্মান শরীরতত্ত্ববিদ রুডল্ফ ভিরখো জার্মান ভাষায় একটি তথ্য উপস্থাপন করেন যার অর্থ ইতিমধ্যে বিদ্যমান কোনো কোষ থেকে নতুন কোষ উৎপন্ন হয়।
কোষ তত্ত্ব গঠন
সময়টা ১৮৩৮ সাল। রাতের নৈশভোজের পর কফি পান করছেন আর নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন দুজন মানুষ। তবে তাদের আলাপ দেশের রাজনীতি বা সিনেমা নিয়ে নয়। তারা আলাপ করছিলেন তাদের গবেষণার বিষয় নিয়ে। আর হবেই না কেন? তারা যে প্রথিতযশা উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। তাদের আলাপের বিষয় ছিল কোষ নিয়ে তাদের গবেষণা। আর কফির আড্ডায় গবেষণা আলাপে মত্ত দুজন বিজ্ঞানী হলেন মাথিয়াস জ্যাকব শ্লেইডেন এবং থিওডোর সোয়ান।
জানা যায় যে, মাথিয়াস জ্যাকব শ্লেইডেনের মুখে উদ্ভিদের কোষের উপস্থিতির কথা শুনে সোয়ান হতবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি নিজেও তার গবেষণায় প্রাণীর টিস্যুতে এমন কোষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হতে তারা দুজনে থিওডোর সোয়ানের গবেষণাগারে ছুটে যান। এরপর সোয়ানের স্লাইড পর্যবেক্ষণ করেন ও দুজনে কোষের উপস্থিতি দেখতে পান। পরের বছর সোয়ান উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন।
কোষ নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ তিনি তিনটি মতামতের মাধ্যমে প্রকাশ করেন:-
১) কোষ হলো জীবিত বস্তুর গঠন, শরীরতাত্ত্বিক ও সংগঠনের মৌলিক একক।
২) জীব গঠনে স্বতন্ত্র সত্তা ও গাঠনিক ব্লক হিসেবে কোষ দ্বৈত অস্তিত্ব বজায় রাখে।
৩) মুক্ত-কোষ গঠনের মাধ্যমে কোষ গঠিত হয় যা অনেকটা ক্রিস্টাল গঠনের মতো (স্বতস্ফুর্ত প্রজন্ম)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কোষ তত্ত্বের তিনটি মূল বিষয় হলোঃ-
- · সকল জীবের গাঠনিক ও কাজের একক কোষ
- · সকল জীব কোষ দিয়ে গঠিত
- · সকল কোষ পূর্বে বিদ্যমান কোষ থেকে উৎপন্ন হয়
আধুনিক কোষ তত্ত্ব
তবে সময়ে সাথে কোষ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। কোষের নতুন নতুন উন্মোচিত তথ্য বিবেচনায় কোষের আধুনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক কোষ তত্ত্ব সাতটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক কোষ তত্ত্বের মূলনীতি হলোঃ-
- · সকল জীব এক বা একাধিক কোষ দিয়ে গঠিত
- · সকল জীবের মৌলিক একক কোষ
- · কোষ বিভাজনের মাধ্যমে একটি কোষ থেকে নতুন কোষ উৎপন্ন হয়
- · কোষের মধ্যে শক্তির প্রবাহ ঘটে
- · কোষ জীনতাত্ত্বিক তথ্য ধারণ করে যা কোষ বিভাজনের মাধ্যমে পিতামাতা থেকে সন্তান সন্তনিতে পরিবাহিত হয়
- · রাসায়নিক গঠনের দিক দিয়ে সকল কোষের মধ্যে মিল আছে
- ·
জীবের
ক্রিয়াকর্ম কোষের কাজের সমন্বিত কাজের বহিঃপ্রকাশ
কোষ জীববিজ্ঞানের ইতিহাস
জীববিজ্ঞান নিয়ে জানতে হলে কোষ নিয়ে জানতে হবে। গবেষকদের দীর্ঘ গবেষণা পরিক্রমায় আমরা কোষ নিয়ে অসংখ্য তথ্য জানতে পেরেছি। তবে কোষ নিয়ে আজকের জ্ঞান শত বছরের ফসল। যুগে যুগে বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে কোষ বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে। নিচে কোষ বিষয়ক তথ্য উদঘাটনের ইতিহাস উল্লেখ করা হল:-
১৫৯৫: জ্যানসেন সর্বপ্রথম যৌগিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র (compound microscope) উদ্ভাবন করেন।
১৬৫৫: কর্ক নিয়ে গবেষণায় রবার্ট হুক ‘কোষ (cells)’ শব্দটি প্রয়োগ করেন।
১৬৭৪: লিউয়েন হুক প্রোটোজোয়া আবিষ্কার করেন। নয় বছর পর তিনি ব্যাকটেরিয়া দেখতে পান।
১৮৩৩: অর্কিড কোষের কোষ প্রাচীর ব্যাখ্যা করেন রবার্ট ব্রাউন
১৮৩৮:
মাথিয়াস জ্যাকব শ্লেইডেন এবং থিওডোর সোয়ান কোষ তত্ত্ব প্রস্তাব করেন।
১৮৪০: আলব্রেক্ট ভন রওলিকার অনুধাবন
করেন যে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর কোষও এক প্রকার কোষ
১৮৫৬: শুক্রাণু কোষ কিভাবে ডিম্বাণু
কোষে প্রবেশ করে এন. প্রিংসেইম পর্যবেক্ষণ করেন।
১৮৫৮: জার্মান
শরীরতত্ত্ববিদ রুডল্ফ ভিরখো জার্মান ভাষায় বলেন ‘omnis cellula e cellula’ যার অর্থ পূর্ববর্তী কোনো কোষ
থেকে নতুন কোষ উৎপন্ন হয়।
১৮৫৭: কলিকার মাইটোকন্ড্রিয়া
ব্যাখ্যা করেন
১৮৭৯: ফ্লেমিং মাইটোসিস কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোসোমের আচরণ ব্যাখ্যা
করেন
১৮৮৩: শুক্রাণু কোষ হ্যাপ্লয়েড,
বংশগতিবিদ্যার ক্রোমোসোম তত্ত্ব প্রকাশিত
১৮৯৮: বিজ্ঞানী গলজি কোষে বিদ্যমান
গলজি বস্তু ব্যাখ্যা করেন
১৯৩৮: বেহরেনস করতে ডিফারেন্টশিয়াল
সেন্ট্রিফিউগেশন পদ্ধতিতে সাইটোপ্লাম থেকে নিউক্লিয়াস আলাদা করেন।
১৯৩৯: সিমেন্স প্রথম বাণিজ্যিক
ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরী করে
১৯৫২: গে ও তার সহকর্মীরা চলমান মানব
কোষ লাইন প্রতিষ্ঠা করেন
১৯৫৭: মেসেলসন, স্টাহল ও ভিনোগার্ড
নিউক্লিক এসিড আলাদা করার জন্য সিজিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণে ডেনজিটি গ্র্যাডিয়েন্ট সেন্ট্রিফিউগেশন
(density gradient centrifugation) পদ্ধতি প্রস্তুত করেন।
১৯৬৫: হ্যাম সিরাম-ফ্রি মিডিয়ামের যাত্রা শুরু করান। ক্যামব্রিজ
ইন্সট্রমেন্ট কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিক স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরী করে
১৯৭৬: স্যাটো ও তার সহকর্মীদের
প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, সিরাম-ফ্রি মিডিয়াতে ভিন্ন ভিন্ন কোষ
লাইনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গ্রোথ ফ্যাক্টর ও হরমোনের মিশ্রণ প্রয়োজন।
১৯৮১: ট্রান্জেনিক ইদুর ও মাছি পোকা
উদ্ভাবন। ইদুরের ভ্রুণের দেহ কোষ লাইন স্থাপন।
১৯৯৮:
দেহ কোষ থেকে ইদুরের ক্লোন তৈরি
১৯৯৯: হ্যামিলটন ও বলকম্বে গাছের পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন সাইলেন্সিং এর অংশ
হিসেবে স্মল ইন্টারফেয়ারিং বা এসআই আরএনএ আবিষ্কার করেন।
২০০৯: একক এডাল্ট দেহ কোষ থেকে উদ্ভুত অর্গানয়েড বিষয়ে গবেষণা পত্র প্রকাশিত
২০১২: CRISPR জীন এডিটিং আবিষ্কার
দক্ষতা যাচাই
১) জীববিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা কোষ বিজ্ঞান। একটি জীবের কোষ নিয়ে যা জানা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো---------
a) কোষ জীবের গাঠনিক ও কাজের একক
b) কোষ জীবের মৌলিক একক
c) সকল জীব একটি মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত
d) মানব দেহ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত
২) একটি কোষে অসংখ্য উপাদান থাকে যারা জীবের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এসকল অঙ্গাণুর মধ্যে------------
a) লাইসোসোম কোষের অপ্রয়োজনীয় পদার্থ ভক্ষণ করে
b) মাইট্রোকন্ড্রিয়া শক্তি উৎপাদনের সাথে জড়িত
c) প্রোটিন একটি অঙ্গাণু যা সাইটোপ্লাজমে থাকে
d) কোষ প্রাচীর বাহ্যিক চাপ থেকে রক্ষা করে যা সকল কোষে পাওয়া যায়।
কমেন্ট বক্সে উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর দিন, আপনার দক্ষতা যাচাই করুন
সম্পাদনা: মোঃ রফিকুল ইসলাম, প্রশিক্ষণ সমন্বয়ক, বায়োলজি স্কুল