-->

রোগ প্রতিরোধী উদ্ভিদ রুকোলা চাষের সম্ভাবনা


ড. মোঃ আব্দুর রহিম


বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে কত প্রজাতির রহস্যময় উদ্ভিদ রয়েছে তার ইয়াত্ত নেই। এমন একটি উদ্ভিদ রুকোলা।  বর্ষজীবি,দুর্বলকান্ড ও সবুজ পাতাবিশিষ্ট এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম ঊৎঁপধ ংধঃরাধ। এই প্রজাতির দেহগত ক্রোমোসোম সংখ্যা ২হ = ২২ এবং বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার ঘটায়। রুকোলা হিসেবে পরিচিত হলেও পৃথিবীল বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন নামে পরিচিত। ইটালীতে ‘রুকোলা’, আমেরিকাতে ‘আরুগুলা’, জার্মানীতে ‘সালাট্রুকা, স্পেনে ‘ইরুকা’ এবং  ফ্রান্সে ‘রকেট’ নামে পরিচিত। রুকোলার উৎপওি স্থান ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে হলেও রোমান কাল থেকে চাষ হওয়ার দরুণ ইটালী এর উতপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে এটি বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ইটালী, ফ্রান্স,পর্তুগাল এবং চেক প্রজাতন্ত্রসহ  মিশর, তুরস্ক ও আমেরিকাতে চাষ করা হচ্ছে। রুকোলা একটি শীতপছন্দকারী উদ্ভিদ। শীতকালে দ্রুত পাতার বৃদ্ধি ঘটে কিন্তু বসন্তকালে গরম আবহাওয়ায় আকাশাভিমূখে ফুলের স্টক তৈরি করে এবং বীজধারণ করে। এর উচ্চতা প্রায় ২০-১০০ সেমি এবং বীজ বপনের এক মাস পরেই পাতা সংগ্রহ করা যায়। রুকোলার পাতা রসালো, লম্বাটে ও খাঁজযুক্ত। শিকড়ছাড়া এ উদ্ভিদের সকল অংশই যেমন-পাতা, ফুল, অপরিপক্ক পড ও বীজ খাবার হিসেবে উপযোগী। তবে খাদ্য হিসেবে পাতা সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। রুকোলার সবুজ সতেজ পাতা সরাসরি কাঁচা সালাদ হিসেবে টমেটো, জলপাই ও পনীরের সাথে, পিৎজা তৈরীর পর পরিবেশনের সময় পিৎজা টপিং হিসেবে, পাস্তার সাথে এবং মাছ ও মাংস দিয়ে তৈরী বিভিন œসুস্বাদু খাবারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।এড়াও এর বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদন করা যায়। কখনও কখনও, এটা শাক হিসাবে পালংশাকের অনুরূপ রান্না করা হয়। সবুজ শাকসবজির স্বাস্থ্য উপকারীতা এখন সর্বজনবিদিত । কারণ এতে স্বাস্থ্য উদ্দীপক রাসায়িনক উপাদানের  প্রাচুর্যতা রয়েছে। নিয়মিত  প্রচুর পরিমানে সবুজ রুকোলা  গ্রহনের মাধ্যমে আমরা ডায়াবেটিস,ক্যান্সার, হৃদরোগ ও রক্তনালী সংক্রান্ত রোগের বিরুদ্ধে আমাদের দেহে প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে পারি। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল নিউট্রিয়েন্ট ডেটাবেস অনুাযায়ী,  প্রতি ১০০  গ্রাম সবুজ রুকোলা পাতাতে শক্তি রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোক্যালরী। তবে পর্যাপ্ত পরিমানে ফলিক অ্যাসিড (৯৭ মাইক্রোগ্রাম), ভিটামিন-এ(২৩৭৩ আইইউ), ভিটামিন-সি (১৫মিলিগ্রাম), ভিটামিন-কে (১০৮.৬ মাইক্রোগ্রাম) এবং ভিটামিন-বি-কমপ্লেক্স রয়েছে ।  গ্রহনযোগ্য মাত্রায় রয়েছে ফ্লাভোনল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বক, ফুসফুস এবং মুখ-গহ্বর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে। রুকোলার পাতাতে  প্রচুর পরিমাণে কপার ও আয়রণ জাতীয় খনিজ উপাদান রয়েছে। তবে স্বল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং ফসফরাস রয়েছে। এছাড়াও এর সবুজ পাতায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসহায়ক রাসায়নিক উপাদান,যেমন-সালফিউরাফ্যান, থায়োসায়ানেটস, আইসো-থায়োসায়ানেটস, ইনডলস ওআলফা-লিপোইক অ্যাসিড। এরা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন-প্রোস্টেট, ব্রেষ্ট, সারভিক্যাল, কোলন এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে। সালফিউরাফ্যান ‘হিস্টোন ডিঅ্যাসিটাইলেজ’ নামক এনজাইমের কার্যকারীতা ব্যাহত করার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। অস্ট্রেলিয়ান ‘রুরাল ইন্ডাস্ট্রিজ রিসার্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট কর্পোরেশন (আরআইআরডিসি)’ এর  প্রাক্কালন মতে, সবুজ রুকোলা পাতার ক্যান্সার  প্রতিরোধ ক্ষমতা সরিষা পরিবারের অন্যান্য শাক-সবজি থেকে অনেক বেশী। রুকোলার সবুজ পাতা যেহেতু সরাসরি পিৎজা এবং সালাদে ব্যাবহৃত হয়, সেহেতু সবুজ পাতায় থাকা ক্লোরোফিল, হেটারোসাইক্লিক অ্যামাইনস এর কার্সেনোজেনিক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। রুকোলাতে বিদ্যমান আলফা-লিপোইক অ্যাসিড রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও নিয়মিত রুকোল াপাতা গ্রহন করলে হৃদপিন্ড এবং রক্ত নালীর রোগের ঝুঁকি কমে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোথাও রুকোলা চাষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে  প্রথম ইটালী থেকে বীজ সংগ্রহ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত ¡ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে এই স্বাস্থ্যপোযোগী উদ্ভিদটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে যে, এটি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সারা বছর জন্মানো উপযোগী,তবে পাতার বৃদ্ধি ও উৎপাদন শীতকালে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু পাতার মত সারা বছর বীজ উৎপাদন করা যায় না, শুধুমাত্র শীতের শেষে বসন্তের প্রারম্ভে এ উদ্ভিদটি ফুল ও বীজ উৎপাদন করে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যপোকারী এই রুকোলার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু সারা বছর পাতা উৎপাদন সম্ভব, সেহেতু গ্রামে বাড়ীর আঙ্গিনায় সামান্য একটু জায়গায় এবং শহরে ৪-৫ টি টবে বাসার ছাদে কিংবা বেলকোনীতে জন্মিয়ে সারা বছর সতেজ পাতা পাওয়া সম্ভব।  



লেখক: সহযোগীঅধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ  প্রজনন বিভাগ

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.