-->

গাছ কেন স্যালিসাইলিক এসিড উৎপন্ন করে?

 

উদ্ভিদের দেহ থেকে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এর মধ্যে স্যালিসাইলিক এসিড অন্যতম। এটি একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ যার আণবিক সংকেত HOC6H4CO2H। মিথাইল স্যালিসাইলেটের আণবিক গঠনের সাথে স্যালিসাইলিক এসিডের গঠনে মিল রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মতো উইলো গাছের বাকলে প্রচুর পরিমাণে স্যালিসাইলিক এসিড পাওয়া যায়।  গ্রীক চিকিৎসাবীদেরা এক প্রকার তিতা স্বাদযুক্ত পদার্থের কথা বলেছিলেন যা বর্তমানে স্যালিসাইলিক এসিড নামে পরিচিত। জ্বর নিরাময় এবং ব্যাথানাশক হিসেবে এই পদার্থ ব্যবহৃত হতো। পাশাপাশি খাদ্য সংরক্ষণ, ত্বকের চিকিৎসায় স্যালিসাইলিক এসিডের বহুল ব্যবহার রয়েছে।  অন্যদিকে আদি আমেরিকানদের মতো মধ্য প্রাচ্যের মানুষ ওষুধ হিসেবে উইলো গাছের বাকল ব্যবহার করতো। বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণায় কয়েক শতাব্দি পর আমরা জানতে পেরেছি যে স্যালিসাইলিক এসিড এসপিরিনের (অ্যাসপিরিন হলো এসিটিস্যালিসাইলিক এসিড) রাসায়নিক উপাদান । জ্বর, ব্যাথা, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, স্ট্রোকের ঝুঁকি, ব্যথা,  ঝিল্লির প্রদাহ চিকিৎসার জন্য অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও উন্নত মানের অসংখ্য ফেস ওয়াশ তৈরীর মূল উপাদান স্যালিসাইলিক এসিড। 

স্যালিসাইলিক এসিড
 এটা সত্য যে উইলো গাছ হতে স্যালিসাইলিক এসিড পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য গাছ স্যালিসাইলিক এসিড  উৎপন্ন করে। গাছের প্রজাতি ভেদে উৎপন্ন স্যালিসাইলিক এসিডের পরিমাণ ভিন্ন হয়। শুধু তাই নয়, গাছ মিথাইল স্যালিসাইলেট উৎপন্ন করে। এটি ব্যাথানাশক মলমের মূল উপাদান। এককথায় স্যালাসাইলিক এসিড বা মিথাইল স্যালিসাইলেট ব্যাথা বা জ্বর নাশক ওষুধের প্রধান উপাদান। তাহলে উদ্ভিদ কেন এসকল পদার্থ উৎপন্ন করে? এসকল ব্যাথানাশক পদার্থ নিজ দেহে উৎপন্ন করার পিছরে রহস্য কি? উদ্ভিদ কি আমাদের উপকারের কথা বিবেচনা করে এই সকল পদার্থ উৎপন্ন করে? অন্যান্য পদার্থের মতো উদ্ভিদ স্যালিসাইলিক এসিড আমাদের উপকারের কথা ভেবে উৎপন্ন করে না। উদ্ভিদ দেহে উৎপন্ন স্যালিসাইলিক এসিড উদ্ভিদ দেহের “প্রতিরক্ষা হরমোন” হিসেবে কাজ করে। স্যালিসাইলিক এসিডের ফলে উদ্ভিদ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা ‍উদ্ভিদের নিরাপত্তা সক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস উদ্ভিদ দেহে আক্রমণ করলে স্যালিসাইলিক এসিড উৎপন্ন হয়। উদ্ভিদ দেহের যেখানে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আক্রমণ করে ঠিক সেখান থেকে স্যালিসাইলিক এসিড উৎপন্ন হয়। এরপর উৎপন্ন স্যালিসাইলিক এসিড প্বাশ্বীয় সজীব (আক্রমিত হয় নি) অংশে পরিবাহিত হয়ে সেই অংশে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। ফলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ সম্প্রসারিত হয় না। এক্ষেত্রে উদ্ভিদের সতেজ (আক্রমিত হয় নি) অংশ বিশেষ জৈবিক পদ্ধতিতে এমন ক্ষমতা অর্জন করে যার দরুণ সেই অংশের কোষ  আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে মেরে ফেলের সক্ষমতা অর্জন করে। ফলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ নির্দিষ্ট অংশের বাইরে হয় না। অনেক সময় আক্রমিত অংশের চারদিকে একটি বৃত্তাকার ব্যারিকেড উৎপন্ন হয় ফলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আক্রমিত অংশের বাইরে যেতে পারে না। মূলত আক্রমিত অংশের চারদিকের কোষের মৃত্যু ঘটে এবং ব্যারিকেড উৎপন্ন হয়। অনেক সময় গাছের পাতায় এমন সাদা রঙের বৃত্তাকার ব্যারিকেড দেখা যায়।  

বৃহৎ আঙ্গিকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহে স্যালিসাইলিক এসিডের কাজ একই। উদ্ভিদ জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে স্যালিসাইলিক এসিড ব্যবহার করে । এককথায় বলতে অসুস্থ হওয়া থেকে মুক্তি পেতে উদ্ভিদ স্যালিসাইলিক এসিড ব্যবহার করে।  অন্যদিকে আমরা প্রাচীন কাল থেকে রোগ নিরাময়ে স্যালিসাইলিক এসিড ব্যবহার করি। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির যুগে ব্যাথানাশক বা জ্বরনাশক হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধের উপাদান হিসেবে স্যালিসাইলিক এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে।

মিথাইল স্যালিসাইলেট স্যালিসাইলিক এসিডের উদ্বায়ী রূপ। বিজ্ঞানী হেলের একটি পরীক্ষায় উদ্ভিদ দেহ থেকে মিথাইল স্যালিসাইলেট নির্গত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। হেলের পরীক্ষায় দেখো গেছে, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমেণের ফলে লিমা বিনে থেকে উদ্বায়ী মিথাইল স্যালিসাইলেট উৎপন্ন হয়। মিথাইল স্যালিসাইলেট হলো স্যালিসাইলিক এসিডের উদ্বায়ী রূপ। হেলের পরীক্ষার ফলাফল রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইলিয়া রাসকিনের গবেষণাকে সমর্থন করে। হেলের গবেষণা চালানোর প্রায় এক দশক পূর্বে ইলিয়া রাসকিন এ সম্পর্কিত গবেষণা পরিচালনা করেন। ইলিয়ান রাসকিনের গবেষণায় উল্লেখ করেন, ভাইরাসের আক্রমণের ফলে তামাক গাছ থেকে উৎপন্ন উদ্বায়ী পদার্থের মধ্যে প্রধান উপাদান হলো মিথাইল স্যালিসাইলেট। এটি দ্রবণীয় স্যালিসাইলিক এসিডের উদ্বায়ী রূপ। উদ্ভিদ দ্রবণীয় স্যালিসাইলিক এসিডকে উদ্বায়ী মিথাইল স্যালিসাইলেটে এবং উদ্বায়ী মিথাইল স্যালিসাইলেটকে দ্রবণীয় স্যালিসাইলিক এসিডে রূপান্তর করতে পারে। অর্থাৎ এই দুইটি পদার্থের  মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে।  একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে স্যালিসাইলিক এসিড ও মিথাইল স্যালিসাইলেট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ধরুণ আপনি তরল মিষ্টি ফলের জুস পান করলেন, এরপর হা করে আপনার বন্ধুর নাকের কাছাকাছি এলে সে মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব করবে। আপনি তরল জুসের স্বাদ পেয়েছেন মিষ্টি, আপনার বন্ধু নাকে মিষ্টি ঘ্রাণ পেয়েছে ।  এককথায় আপনি তরল মিষ্টি স্বাদ গ্রহণ করেছেন এবং মুখ থেকে উদ্বায়ী মিষ্টি ঘ্রান নির্গত করেছেন।  একইভাবে গাছ স্যালিসাইলিক এসিডের স্বাদ গ্রহণ করে এবং ঘ্রাণ হিসেবে মিথাইল স্যালিসাইলেট নির্গত করে। আমরা জানি স্বাদ ও ঘ্রাণ পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত। প্রধান পার্থক্য হলো, আমরা স্বাদ হিসেবে দ্রবণীয় পদার্থ গ্রহণ করি, অন্যদিকে আমরা উদ্বায়ী পদার্থ রূপে ঘ্রাণ নির্গত করি।

 সূত্রঃ “What a Plant Knows” book written by Daniel Chamovitz

অনুবাদঃ রফিকুল ইসলাম

 

No comments

Powered by Blogger.