-->

কোষ রাজ্যের জানা-অজানা (৬ষ্ট পর্ব): সাইটোস্কেলেটন


 যখন তুমি কোনো কোষ পর্যবেক্ষণ করো, তখন কি দেখতে পাও? মনে করো, তুমি সাধারণ একটি অণুবীক্ষণযন্ত্রে কোষ পর্যবেক্ষণ করছ। হয়তো বা কিছু কিছু অঙ্গাণু তোমার চোখে ধরা পড়বে। অন্যভাবে তুমি পাঠ্যপুস্তকে কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণু নিয়ে যখন পড়াশোনা করো, তখন অঙ্গাণুর অবস্থান সম্পর্কে কি পড়? অঙ্গাণুগুলো দেখে বা তার সম্পর্কে পড়ে মনে হয় একটি কোষের মধ্যে অঙ্গাণুগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকটা একটা বড় পাত্রের মধ্যে রসগোল্লা রাখার মত। যেন রসের মধ্যে ভাসমান মিষ্টি। কোষের অঙ্গাণুগুলো কি আসলেই এভাবেই কোনো সংযোগ ছাড়া একাকি অবস্থান করে? বিষয়টি তা নয়। ইলেক্ট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবনের প্রাথমিক সময়ে মনে করা হতো ইউক্যারিওটিক কোষের সাইটোসলে বিভিন্ন অঙ্গাণু মুক্তভাবে ভেসে বেড়ায়। তবে আলোক ও ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের উন্নতি সাধনের ফলে কোষের অভ্যন্তরের অঙ্গাণুর বিচরণ প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়েছে। উন্নত অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কোষের পুরো সাইটোপ্লাজম জুড়ে সূতার মতো জালের সন্ধান পাওয়া গেছে যা সাইটোস্কেলেটন (Cytoskeleton) নামে পরিচিত।

ইউক্যারিওটিক কোষের মতো ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রোটিন দিয়ে গঠিত তন্তু থাকে যা বিশেষ প্রকার সাইটোস্কেলেটন তৈরী করে। তবে এখানে শুধু ইউক্যারিওটিক কোষের সাইটোস্কেলেটন সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ইউক্যারিওটিক কোষের সাইটোস্কেলেটন কোষের গঠন ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউক্যারিওটিক কোষের সাইটোস্কেলেটনে তিন প্রকার আণবিক গঠন দেখা যায়ঃ মাইক্রোটিউবিউল (Microtubules), মাইক্রোফিলামেন্ট (Microfilaments) এবং অন্তবর্তী ফিলামেন্ট (Intermediate Filaments). চিত্র ৬.১-এ কোষের অভ্যন্তরে সাইটোস্কেলেটনের চিত্র দেখানো হয়েছে। চিত্রে কোষে বিস্তৃত সাইটোস্কেলেটনের পাশাপাশি এর মাইক্রোটিউবিউল (Microtubules), মাইক্রোফিলামেন্ট (Microfilaments)  গঠন স্পষ্ট হয়েছে। তবে প্রদত্ত চিত্রে  সাইটোস্কেলেটনের  অন্তবর্তী ফিলামেন্ট (Intermediate Filaments স্পষ্ট নয়।

চিত্র ৬.১: সাইটোস্কেলেটন
 

 কোষে সাইটোস্কেলেটনের ভূমিকা

কোষের দৃঢ়তা প্রদান ও সঠিক আকার প্রদানে সাইটোস্কেলেটন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি কোষের কার্য সম্পাদনে এটি খুব জরুরী। কোষ প্রাচীর না থাকায় প্রাণীকোষের সঠিক আকার ও দৃঢ়তা প্রদানে সাইটোস্কেলেটন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একটি কোষ কতটা দৃঢ় বা স্থিতিস্থাপক ধর্ম প্রদর্শন করে তা কোষের গঠনের ওপর নির্ভর করে। গাঠনিক উপাদান ও অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এর স্থিতিস্থাপক ধর্ম বা দৃঢ়তা কম বেশি হয়। দৃঢ়তা প্রদানের পাশাপাশি সাইটোস্কেলেটন কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণুসমূহকে নির্দিষ্ট অবস্থানে যুক্ত করে রাখে। এটি অনেকটা আমাদের কঙ্কালতন্ত্রের মত। তবে আমাদের কঙ্কালতন্ত্রের সাথে সাইটোস্কেলেটনের তফাৎ রয়েছে। এর কারণ হলো কঙ্গালতন্ত্র নির্দিষ্ট আকার আছে এবং তার গঠন সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। অন্যদিকে সাইটোস্কেলেটন পরিবর্তনশীল। দেখা যায় কোষের কোনো অংশে এটি আছে, খুব দ্রুত তা অদৃশ্য হয়ে আবার অন্য অংশে জড়ো হয়। এককথায়, খুব দ্রুত এটি দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হতে পারে এবং স্থান পরিবর্তন করতে পারে।

বিজ্ঞানীরা এি বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যে কিছু কোষের চলন ঘটে। এককথায় কিছু কোষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। কোষের কোন স্থান পরির্বতন বা কোষের অভ্যন্তরস্থ অঙ্গাণুসমূহের স্থান পরিবর্তনকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় সেল মোটালিটি (Cell Motality)। সাইটোস্কেলেটন ও মোটর প্রোটিনের (Motor Protein). পারস্পরিক ক্রিয়ায় কোষ স্থান পরিবর্তন করে। সাইটোস্কেলেটন উপাদান ও মোটর প্রোটিন একসাথে প্লাজমামেমব্রেনের সাথে ক্রিয়া করায় কোষ স্থানান্তরিত হয়। অন্যদিকে মোটর প্রোটিনের সাহায্যে কোষের অভ্যন্তরে ভেসিকল ও বিভিন্ন অঙ্গাণু পরিভ্রমণ করে। ভেসিকলযুক্ত নিউরোট্রান্সমিটার অণু এই পদ্ধতিতে স্নায়ুকোষের অ্যাক্সনের শীর্ষভাগে পৌঁছে। অ্যাক্সন হলো একটি স্নায়ু কোষের বর্ধিত অংশ। স্নায়ুতন্ত্রে একটির সাথে একটি স্নায়ুকোষ যুক্ত থাকে। কোনো একটি স্নায়ুকোষ প্রাপ্ত সংকেত অ্যাক্সনের মাধ্যমে পরবর্তী স্নায়ুকোষে পরিবহন করে। এক্ষেত্রে অ্যাক্সনের শীর্ষভাগে পৌঁছানো নিউরোট্রান্সমিটার অণু সংকেত রূপে পরবর্তী স্নায়ুকোষে পরিবাহিত হয়। চিত্র ৬.২-এ মোটর প্রোটিন ও সাইটোস্কেলেটন দেখানো হয়েছে।

চিত্র ৬.২: মোটর প্রোটিন ও সাইটোস্কেলেটনের ক্রিয়া

 

সাইটোস্কেলেটনের উপাদান 

ইতোমধ্যে তিন প্রকার সাইটোস্কেলেটেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বিভিন্ন প্রকার সাইটোস্কেলেটন সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।  মাইক্রোফিলামেন্টস (একে অ্যাকটিন ফিলামেন্ট বলা হয়) সবচেয়ে পাতলা, মাইক্রোটিউবিউল সর্বাধিক মোটা। অন্যদিকে মাইক্রোফিলামেন্টস ও মাইক্রোটিউবিউলের আকারের মধ্যবর্তী ব্যাসবিশিষ্ট তন্তু হলো  ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টস।

মাইক্রোটিউবিউল

সকল ইউক্যারিওটিক কোষে মাইক্রোটিউবিউল থাকে। ফাঁপা দন্ডাকার এই সাইটোস্কেলেটনের ব্যাস ২৫ ন্যানোমিটার এবং দৈর্ঘ্য ২০০ ন্যানোমিটার থেকে ২৫ মাইক্রোমিটার। মাইক্রোটিউবিউল টিউবুলিন নামক ক্ষুদ্র গোলাকার প্রোটিন দিয়ে তৈরি। টিউবুলিন প্রোটিন হলো ডাইমার। দুইটি ভিন্ন প্রৃকতির পলিপেপটাইড দিয়ে টিউবুলিন ডাইমার গঠিত। এর একটি আলফা টিউবুলিন, অন্যটি বিটা টিউবুলিন। টিউবুলিন ডাইমারগুলো দৈর্ঘ্য বরাবর একটার সাথে আরেকটা যুক্ত হয়ে দীর্ঘাকার মাইক্রোটিউবিউল গঠন করে। টিউবুলিন ডাইমারের বিন্যাসের ভিন্নতার কারণে মাইক্রোটিউবিউলের দুই প্রান্তের গঠন ভিন্ন হয়। মাইক্রোটিউবিউলের এক প্রান্তে অন্য প্রান্ত অপেক্ষা অধিক হারে টিউবুলিন জমা ও বিমুক্ত হয়। এই প্রান্তকে বলা হয় প্লাস এন্ড (plus end). মাইক্রোটিউবিউলস কোন একটি কোষের সঠিক আকার প্রদান করে এবং কোষকে দৃঢ়তা প্রদান করে। এছাড়াও মোটর প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গাণু কোনদিকে পরিভ্রমণ করবে তা মাইক্রোটিউবিউলস নির্দেশ করে। মাইক্রোটিউবিউলের নির্দেশনা অনুযায়ী এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে প্রোটিন উৎপন্ন হয়ে তা ভেসিকলের মাধ্যমে গলজি বস্তুতে প্রবেশ করে। এছাড়াও কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোসোম বিভক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার হওয়ার সাথে মাইক্রোটিউবিউলস জড়িত।  

চিত্র ৬.৩: মাইক্রোটিউবিউল

 সেন্ট্রোসোম ও সেন্ট্রিওল : প্রাণিকোষের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসের সন্নিকটে সেন্ট্রোসোম নামক বিশেষ ধরনের অঙ্গাণু বিদ্যমান। সেন্ট্রোসোম থেকে মাইক্রোটিউবিউল উৎপন্ন হয়ে বর্ধিত হয়। এই মাইক্রোটিউবিউল প্রাণীকোষের সাইটোস্কেলেটনের সংকোচন প্রসারণ ঘটায়। সেন্ট্রোসোমের অভ্যন্তরে সেন্ট্রিওল থাকে। নয় সেট ত্রিপদী মাইক্রোটিউবিউল রিং আকারে বিন্যস্ত হয়ে সেন্ট্রিওল গঠন করে। চিত্র ৬.৪-এ সেন্ট্রোসোম ও সেন্ট্রিওলের গঠন দেখানো হয়েছে। সেন্ট্রোসোমের অভ্যন্তরে থাকা সেন্ট্রিওলের প্রতিটির ব্যাস আনুমানিক ২৫০ ন্যানোমিটার।

চিত্র ৬.৪: সেন্ট্রোসোম ও সেন্ট্রিওলের গঠন
 সেন্ট্রোসোম ও সেন্ট্রিওল মিলে প্রাণিকোষের মাইক্রোটিউবিউলস বিন্যস্ত করে রাখে। তবে যে সকল ইউক্যারিওটিক কোষে সেন্ট্রোসোম ও সেন্ট্রিওল নেই তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন উপায়ে মাইক্রোটিউবিউলস বিন্যস্ত থাকে

সিলিয়া এবং ফ্ল্যাজেলা: ইউক্যারিওটিক জীবে বিশেষ ধরনের অঙ্গাণু থাকে যা সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলা। মূলত এটি মাইক্রোটিউবিউল দিয়ে গঠিত কোষের প্রবর্ধিত অংশ। মাইক্রোটিউবিউলসের বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলার কাজ সম্পাদিত হয়। অবস্থানভেদে ফ্ল্যাজেলা বা সিলিয়ার কাজ ভিন্ন। কিছু কিছু এককোষী ইউক্যারিওটিক জীব সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলার মাধ্যমে পানিতে ভেসে বেড়ায়। একইভাবে প্রাণির শুক্রাণুর কোষ, ছত্রাক ও কিছু সংখ্যক উদ্ভিদে ফ্ল্যাজেলা থাকে।

সাধারণ কোন একটি টিস্যুস্তর থেকে বিবর্ধিত হয়ে সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলা তৈরী করে। এককথায় জীব গাত্রের কোন একটি অংশের কোষগুচ্ছ বিবর্ধিত হয়ে ফ্ল্যাজেলা বা সিলিয়া সৃষ্টি করে। সাধারণত কোষীয় পৃষ্ঠে অসংখ্য গতিশীল সিলিয়া দেখা যায়। প্রতিটি সিলিয়ার ব্যাস ০.২৫ মাইক্রোমিটার এবং দৈর্ঘ্য ২-২০ মাইক্রোমিটার। ফ্ল্যাজেলার ব্যাস সিলিয়ার মতই, তবে দৈর্ঘ্য ১০-২০০ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। কোন একটি কোষে অসংখ্য সিলিয়া থাকে। তবে সাধারণত কোষে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্ল্যাজেলা থাকে। ফ্ল্যাজেলা সিলিয়া অপেক্ষা লম্বা হয়। 

ফ্ল্যাজেলা ও সিলিয়ার কাজের ধরণ ভিন্ন। ফ্ল্যাজেলা সাধারণত কোষের দৈর্ঘ্য বরাবর বল প্রয়োগ করে। ফলে কোষ ফ্ল্যাজেলা প্রদত্ত গতিপথে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ফ্ল্যাজেলার ফলে কোষ মাছের মতো সামনের দিকে চলতে পারে। মাছের লেজের মত কোষের একপ্রান্তে ফ্ল্যাজেলা থাকে। ফলে মাছ যেভাবে পাখনা নাড়িয়ে সামনে দিকে চলে, একইভাবে ফ্ল্যাজেলাযুক্ত কোষ সামনের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে সিলিয়া একটি কোষের চারদিকে সূতার মত ঝুলতে থাকে। সিলিয়ার কাজ অনেকটা নৌকার বৈঠা টানার মত। নৌকার বৈঠার মতো সিলিয়া কোষকে গতিশীল করে। চিত্র ৬.৫-এ ফ্ল্যাজেলা ও সিলিয়ার কাজের প্রকৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। ৬.৫ (ক) নং চিত্রে শুক্রাণুর কোষের চলন প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। ফ্ল্যাজেলার মাধ্যমে শুক্রাণু গতিশীল হয়। ফ্ল্যাজেলার গতি পথ সাপের মতো। সাপের মতো বল প্রয়োগের মাধ্যমে এটি সামনের দিকে ধাবিত হয়। ৬.৫ (খ) চিত্রে সিলিয়ার গতি প্রকৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। সিলিয়া সামনে  ও পিছনের দিকে গতিশীল। চলার সময় দ্রুত বেগে ধাক্কা দেওয়ায় সিলিয়ামের সমকোণে কোষ সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর ধাক্কার বেগ হ্রাস করলে সিলিয়াম কোষের পৃষ্ঠতলের দিকে বেঁকে যায় অর্থাৎ কোষের গাঁ ঘেঁষে থাকে। চলার সময় গড়ে প্রতি সেকেন্ডে একটি সিলিয়াম ৪০ থেকে ৬০ বার ধাক্কা দেয়।   

চিত্র ৬.৫: ফ্লাজেলা ও সিলিয়ার গতিপথের তুলনা

অনেক সময় সিলিয়া (একবচনে-সিলিয়াম) কোষের সংকেত গ্রাহক এন্টেনা হিসেবে কাজ করে। তবে এই ধরনের সিলিয়াযুক্ত কোষ গতিশীল নয় এবং প্রতিটি কোষে মাত্র একটি সংকেত গ্রাহক সিলিয়া থাকে। মেরুদন্ডী প্রাণি দেহের কোষে এমন সিলিয়াম দেখা যায় যা প্রাইমারি সিলিয়াম (Primary Cilium) নামে পরিচিত। কোষের বাইরের পরিবেশ থেকে এই সিলিয়ামের মাধ্যমে কোষ অভ্যন্তরে বিভিন্ন সংকেত পরিবাহিত হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন ও ভ্রুণের বৃদ্ধিতে প্রাইমারি সিলিয়ামের বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।  

দৈর্ঘ্য, কার্যপদ্ধতি ও সংখ্যায় ভিন্ন হলেও সিলিয়াম ও ফ্ল্যাজেলামের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অসংখ্য মাইক্রোটিউবিউল পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সিলিয়াম ও ফ্ল্যাজেলাম গঠন করে। মাইক্রোটিউবিউল বিশেষ পদ্ধতিতে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সিলিয়াম ও ফ্ল্যাজেলাম গঠন করে। দুইটি একক মাইক্রোটিউবিউলকে কেন্দ্র করে নয়টি ডাবলেট মাইক্রোটিউবিল বৃত্তাকারে বিন্যস্ত  থাকে। মাইক্রোটিউবিউলের এই বিন্যাসকে ৯ + ২ প্যাটার্ন বলে। অর্থাৎ কেন্দ্রে দুইটি মাইক্রোটিউবিল এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে সজ্জিত নয়টি মাইক্রোটিউবিউল।  সাধারণত সচল সিলিয়া ও সব ধরণের ইউক্যারিওটিক জীবের ফ্লাজেলায় মাইক্রোটিউবিউলের ৯ + ২ বিন্যাস দেখা যায়।

তবে নিশ্চল প্রাইমারি সিলিয়ায় মাইক্রোটিউবিউলের বিন্যাস হলো ৯ + ০ । অর্থাৎ তাদের কেন্দ্রে কোনো মাইক্রোটিউবিউল থাকে না। বিন্যাস থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে পরিধিতে বিন্যস্ত মাইক্রোটিউবিউলের সাথে কেন্দ্রীয় মাইক্রোটিউবিউলের পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ফ্ল্যাজেলা বা সিলিয়া গতিশীল হয়। কোন কোষের ফ্ল্যাজেলা বা সিলিয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে তা কোষের সাথে যুক্ত থেকে সূতার মতো বাইরের দিকে প্রবর্ধিত হয়েছে। কোষের একটি নির্দিষ্ট অংশের সাথে সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলা যুক্ত থাকে যা বেসাল বডি (Basal body) নামে পরিচিত।  এককথায় বেসাল বডির মাধ্যমে সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলা কোষের সাথে ঝুলে থাকে। আমরা প্রত্যেহ চারপাশে এমন উদাহরণ দেখতে পাই। দেখবে অনেকসময় কোন দেয়ালে ইউ আকৃতির ধাতব দন্ড ঢুকিয়ে তার সাথে রশি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তুমি যদি রশিকে দুলাতে থাক তাহলে কিন্তু ঐ ধাতব দ- দুলবে না। এটি মূলত দেয়ালের সাথে রশিকে ঝুলে থাকতে সাহায্য করে। বেসাল বডির গঠন অনেকটা কোষের সেন্ট্রিওলের মতো। এদের মাইক্রোটিউবিউল বিন্যাস (৯ + ০) প্যাটার্নের অর্থাৎ পরিধিস্থ মাইক্রোটিউবিউল থাকলেও কেন্দ্রে কোন মাইক্রোটিউবিউল নেই। ফলে এরা গতিশীল নয়। মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীর সক্রিয় শুক্রাণুর বেসাল বডি ডিম্বানুতে প্রবেশ করে নিষেকে উৎপন্ন কোষের সেন্ট্রিওলে পরিণত হয়। 

কিভাবে মাইক্রোটিউবিউলের বিন্যাস ফ্ল্যাজেলাম বা সচল সিলিয়ামকে বাঁকতে সাহায্য করে? ফ্ল্যাজেলাম বা সিলিয়ামের বাঁক নেওয়ার সাথে ডায়নিন নামক বিশেষ প্রকৃতির মটর প্রোটিন জড়িত। পরিধিস্থ নয়টি মাইক্রো টিউবিউলগুলো ডাবলিন প্রোটিন দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে (চিত্র ৬.৬)। সাধারণত একটি ডায়ানিনের দুইটি ’পা (feet)’ থাকে এবং এরা পাশাপাশি মাইক্রোটিউবিউলে হেঁটে (walk) যেতে পারে। এসময় ডায়ানিনের একটি পা কোনো একটি মাইক্রোটিউবিউলে থাকে, অন্য পা ছেড়ে দেয় এবং এক ধাপ সামনের মাইক্রোটিউবিউলকে স্পর্শ করে, এরপর পূর্বের পা ছেড়ে দেয় এবং পুনরায় সামনের মাইক্রোটিউবিউলকে স্পর্শ করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। 

প্রোটিন পরিধিস্থ ও কেন্দ্রস্থ মাইক্রো টিউবিউলগুলোকে পরস্পরের সাথে ক্রস লিংকিং প্রোটিন (Cross Linking Protein) দিয়ে যুক্ত থাকে (চিত্র ৬.৬)। লিংকিং প্রোটিন মাইক্রো টিউবিউলের সাপেক্ষে ডায়ানিনের হাঁটার গতি সমন্বয় করে। লিংকিন প্রোটিন থাকায় পাশ্বীয় বৃত্তাকারে বিন্যস্ত মাইক্রোটিউবিউলগুলো সঠিক স্থানে থাকে, ফলে ডায়ানিন বৃত্তাকার ভাবে ঘুরে আসতে পারে। যদি কোনো একটি মাইক্রোটিউবিল নির্দিষ্ট অবস্থানে না থাকতো তাহলে ডায়ানিন সঠিকভাবে পরিভ্রমণ করতে পারতো না। চিত্র ৬.৬-এ ফ্লাজেলাম ও সচল সিলিয়ার গঠন দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি মাইক্রোটিউবিউলের বিন্যাস, ডায়ানিন, ক্রস-লিংকিং প্রোটিনের অবস্থান দেখানো হয়েছে।

চিত্র ৬.৬: ফ্লাজেলাম ও সিলিয়ার গঠন বিন্যাস

মাইক্রোফিলামেন্ট বা অ্যাকটিন ফিলামেন্ট

মাইক্রোফিলামেন্ট পাতলা দৃঢ় দন্ডের মত। প্রতিটি দন্ডের ব্যাস ৭ ন্যানোমিটার। অ্যাকটিন নামক এক প্রকার বৃত্তাকার প্রোটিন দিয়ে মাইক্রোফিলামেন্ট গঠিত। তাই মাইক্রোফিলামেন্টকে অ্যাকটিন ফিলামেন্ট বলা হয়। অ্যাকটিন প্রোটিন পরস্পর যুক্ত হয়ে বৃহৎ শিকল গঠন করে। এমন দুইটি শিকল পরস্পর সাপের মত পেঁচিয়ে মাইক্রোফিলামেন্ট গঠিত হয়। পাটের আঁশ থেকে দড়ি বানানোর সময় আমরা এমন কৌশল দেখে থাকি। দেখা যায় প্রতিটি দড়িতে দুইটি বাহু পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। লম্বা শিকলের গঠন হলেও মাইক্রোফিলামেন্ট শিকল পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহৎ জালিকা গঠন করে। এক্ষেত্রে বিশেষ প্রকার প্রোটিন পাশাপাশি অবস্থিত মাইক্রোফিলামেন্টকে যুক্ত করে। মাইক্রোটিউবিউলের মত সকল ইউক্যারিওটিক কোষে মাইক্রোফিলামেন্ট বিদ্যমান।  চিত্র ৬.৭ এ মাইক্রোফিলামেন্ট এর গঠন দেখানো হয়েছে।

চিত্র ৬.৭: মাইক্রোফিলামেন্ট
মাইক্রোফিলামেন্ট বাহ্যিকভাবে প্রযুক্ত চাপ সহ্য করতে পারে। ফলে কোষের সাইটোস্কেলেটন বাহ্যিক চাপকে প্রতিহত করতে পারে। এর কাজ দড়ি দিয়ে তৈরি জালিকাকার দোলনার মত। 

অনেক সময় আমরা এমন দোলনা দেখে থাকি। যেখানে দোলনার দুই প্রান্তে দুই পাশের দুইটি খুটির সাথে বাঁধা থাকে। এই দোলনায় বসে যে কেউ দোল খেতে পারে। যখন দোলনার ওপর কোন ব্যক্তি বসে তার ওজনের সমান চাপ প্রযুক্ত হয়। তবে পাটের দড়িগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে জালিকাকার গঠন করায় খুব সহজে ব্যক্তির চাপ সহ্য করতে পারে। একইভাবে মাইক্রোফিলামেন্টের কারণে কোষ বাইরের কোন চাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। প্লাজমামেমব্রেনের ঠিক নিচে মাইক্রো ফিলামেন্টের ত্রিমাত্রিক জালিকা থাকে। এর ফলে কোষ সঠিক আকার লাভ করে। পাশাপাশি এই ত্রিমাত্রিক জালিকা সাইটোপ্লাজমের বাইরে একটি পাতলা স্তর তৈরী করে যা কর্টেক্স নামে পরিচিত। সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরের তরল দ্রবণের তুলনায় কর্টেক্স অর্ধতরল। কর্টেক্স মূলত তরল ও কঠিনের মধ্যবর্তী অবস্থা যাকে সেমিসলিড (Semisolid) বলে। কিছু প্রাণীকোষে বিশেষ করে অন্ত্রের কোষে অসংখ্য মাইক্রোফিলামেন্ট একত্রে মাইক্রোভিলি গঠন করে (চিত্র ৬.৮)। এর ফলে কোষের উপরিভাগের পৃষ্ঠতল বৃদ্ধি পায়। 

  

ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট

আকারের ভিত্তিতে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টের নামকরণ করা হয়েছে। এর ব্যাস মাইক্রোফিলামেন্ট থেকে বেশি কিন্তু মাইক্রোটিউবিউলস থেকে কম। সাধারণত ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টের ব্যাস ৮-১২ ন্যানোমিটার। এটি মাইক্রোফিলামেন্টের মত বাহ্যিক চাপ সহ্য করতে পারে। প্রায় সকল ইউক্যারিওটিক কোষে মাইক্রোফিলামেন্ট ও মাইক্রোটিউবিউলস থাকে। তবে কিছু সংখ্যক প্রাণীকোষে যেমন মেরুদন্ডী প্রাণী কোষে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট থাকে। বিশেষ প্রকার প্রোটিন দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট গঠিত। এমন একটি প্রোটিন হলো কেরাটিন (Keratin)।

সাধারণত কোষের কোনো একটি অংশে  মাইক্রোটিউবিউল ও মাইক্রোফিলামেন্টের উপস্থিতি সাময়িক। কোষের এক অংশে বিদ্যমান মাইক্রোটিউবিউল অদৃশ্য হতে পারে, আবার অন্য অংশে দেখা যেতে পারে। তবে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। এটি মাইক্রোটিউবিউল ও মাইক্রোফিলামেন্ট অপেক্ষা অধিক স্থায়ী। এমনকি কোষের মৃত্যু ঘটলেও ইন্টারমিডিয়েট মাইক্রোফিলামেন্ট পাওয়া যায়।  উদাহরণ হিসেবে মানুষের ত্বকের বহিঃস্তরের কথা বলা যেতে পারে। এটি কেরাটিন প্রোটিন সমৃদ্ধ মৃত কোষ দিয়ে গঠিত। কোন একটি জীবন্ত কোষের সাইটোপ্লাজমে রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট (বিশেষ রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত করা) করলে মাইক্রোফিলামেন্ট ও মাইক্রোটিউবিউল বিলুপ্ত হবে। অতপর দেখা যাবে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টের একটি আস্তরণ অবশিষ্ট রয়েছে। এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে কোনো একটি কোষে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট স্থায়ীভাবে অবস্থান করে। কোষের আকার গঠনে ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি এটি কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণুকে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে সহায়তা করে। চিত্র ৬.৯-এ ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্টের চিত্র দেখানো হয়েছে।

চিত্র-৬.৯: ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট

সাধারণ আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে দেখা না গেলেও, শক্তিশালী ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যায় নিউক্লিয়াস একটি খাঁচার মত আবরণে অবস্থান করে। নিউক্লিয়ার ঝিল্লির ঠিক নিচে নিউক্লিয়ার ল্যামিলা নামক জালিকা থাকে, যা ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট দিয়ে তৈরি। আকার গঠনের পাশাপাশি কোষর বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে এটি ভূমিকা পালন করে। স্নায়ু কোষের অ্যাক্সনের বিষয়ে আমরা জানি। স্নায়ু কোষ হলো উদ্দীপনা বহনকারী অঙ্গাণু। দেহের সকল অংশে স্নায়ুকোষের বিস্তৃতি রয়েছে। স্নায়তন্ত্রের কেন্দ্রস্থল হলো মস্তিষ্ক। মনে করো, হাতের উপর মশা বসছে, রক্ত গ্রহণের চেষ্টা করছে। তখন এর উপস্থিতি সংকেত হিসেবে স্নায়ুকোষের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছাবে। মস্তিষ্ক হলো নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। অবস্থা ভেদে এটি সিদ্ধান্ত দেবে মশাটিকে মারতে হবে নাকি অপেক্ষা করতে হবে।  মস্তিষ্কের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনরায় বার্তা প্রবাহিত হয় এবং নির্দিষ্ট অঙ্গ কাজ করে। স্নায়ুতন্ত্রের গাঠনিক একক নিউরন। অসংখ্য নিউরন কোষ পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে স্নায়ুতন্ত্র গঠন করে। অনেকটা ইটের গাঁথুনি দিয়ে বিশাল ভবন নির্মাণের মত। অ্যাক্সন নিউরন কোষের একটি বিবর্ধিত অংশ যা পরবর্তী নিউরনের ডেনড্রাইটের সাথে যুক্ত হয়। বিভিন্ন বার্তা অ্যাক্সনের মধ্য দিয়ে পরবর্তী ডেনড্রাইট, তারপর ঐ নিউরনের অ্যাক্সনের ভিতর দিয়ে পরবর্তী নিউরনের ডেনড্রাইটে পরিবাহিত হয়। নিউরনের অ্যাক্সনে ইন্টারমিডিয়েটে ফিলামেন্ট থাকে। ফলে অ্যাক্সন দৃঢ় হয়। 

সাইটোস্কেলেটন সম্পর্কে কী জানলে? নিজেকে যাচাই করতে নিজের দক্ষতা লেভেল জানার জন্য মনযোগ দিয়ে পড় ও মডেল টেস্ট দাও। পরবর্তীতে মডেল টেস্ট নেওয়া হবে।

সূত্র: Campbell Biology (মূল ক্যাম্পবেল বায়োলজির কোষ ইউনিট নিয়ে বাংলায় “ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) প্রকাশ করেছে ল্যাববাংলা প্রকাশনী)

জীববিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানতে ও জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হতে ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট) ও ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) বই দুইটি পড়তে পারো।

 

লেখক পরিচিতি: রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞান কর্মী ও লেখক। ২০০৭ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিজ্ঞান আন্দোলন ও লেখালেখির সাথে জড়িত। বাংলাদেশ বায়োলজি অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী কোচ। বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কর্মরত। সম্পাদিত বই: ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট), ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট), বীজগণিত সমগ্র (১ম ও ২য় খন্ড) ।   

No comments

Powered by Blogger.