-->

কার্বন নির্গমন হ্রাসে ছয়টি অভ্যাস

 জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে পৃথিবী আজ কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া রোধে বিভিন্ন উদোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশে তাপমাত্রা হ্রাস, কার্বন নিগর্মনের হার কমানো নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ও উদ্যোগের শেষ নেই। এটা সত্য যে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী প্রতিষ্টার লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে বিশ্বের সকল দেশকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বৃহৎ আঙ্গিকে ফলপ্রসূ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এমন কিছু উদ্যোগ রয়েছে যা খুব সহজে পরিবেশে কার্বন নিগর্মনের হার কমাতে পারে। আমাদের প্রতিদিনের কাজের সাথে জড়িত এমন ছয়টি উদ্যোগ নিয়ে আমাদের আলোচনা

ফ্লাইট সংখ্যা হ্রাস

বর্তমান সময়ে মানুষের ভ্রমণের অন্যতম মাধ্যম আকাশপথ। আকাশপথে বিমানে মানুষ একদেশ থেকে অন্য দেশে খুব সহজে ভ্রমণ করা যায়। পাশাপাশি হেলিকপ্টার, জেট বিমান প্রভৃতিতো আছেই। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন যে, যদি হঠাৎ করে সব বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কমপক্ষে শতকরা ২.৫ ভাগ কার্বন নিগর্মন হ্রাস পাবে।

উড্ডয়ন খাতে প্রতি বছর এক বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন ক্লিন ট্রান্সপোর্টেশনের তথ্য মতে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে উড্ডয়ন খাতে কার্বন নিগর্মনের হার শতকরা ৩০ ভাগ ‍বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা সংকটে কিছুটা কম থাকলেও বর্তমানে উড্ডয়ন খাতে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনামূলকভাবে উড্ডয়ন খাতে নিগর্মন কম মনে হলেও , প্রতিটি ফ্লাইটে প্রচুর পরিমাণ গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইটে প্রায় এক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। 

এটা সত্য যে উড্ডয়ন খাত বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা ফ্লাইট সংখ্যা কমাতে পারি। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকবো। ভ্রমণের জন্য আমাদের বিকল্প মাধ্যমে অভ্যস্ত হতে পারি। ভ্রমণের জন্য বাস বা ট্রেনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এসকল পরিবহণে বিমানের  তুলনায় কম নিগর্মন হয়। পাশাপাশি আমরা বিমানে পূর্বের তুলনায় ভ্রমণ সংখ্যা কমাতে পারি। দেখা যাচ্ছে পূর্বে মাসে দশবার ভ্রমণ করতাম। এখন পাঁচবার বিমানে ভ্রমণ করে, বাঁকীটা অন্য মাধ্যমে ভ্রমণ করতে পারি। তবে বর্তমানে বিমানের জ্বালানী হিসেবে বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিগর্মন কমানোর জন্য অনেক বিমান জৈব জ্বালানী, নবায়নযোগ্য শক্তি বা হাইড্রোজেন থেকে উৎপন্ন সিনথেটিক জ্বালানীর দিকে ঝুঁকছে।

খাদ্য অভ্যাস

আমাদের প্রতিদিনের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য থেকে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়  গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের খাদ্য অভ্যাস উদ্ভিদ খাদ্য নির্ভর হলে প্রতিবছর ০.৮ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিগর্মন গ্রাস পাবে।  যদি পৃথিবীর সবাই ‍উদ্ভিদ নির্ভর খাদ্যের দিকে ঝঁকে যায়, তাহলে পৃথিবীর ৭৫ ভাগ কৃষি জমি মুক্ত হবে যা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে। এটা সত্য যে সকল মানুষ চাইলেই ‍খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ নির্ভর হতে পারবে না। তবে আমাদের প্রতিদিন এমন কিছু খাবার গ্রহণ করতে হবে যেখান থেকে কম পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। আগামী বিশ্ব এমন কিছু খাবারের খোঁজ করছে যেখান থেকে কম হারে ক্ষতিকর গ্যাস নিসৃত হবে। পাশাপাশি প্রতিদিনের খাবারে প্রাণীজ উৎসের পরিমাণ কমাতে হবে। 

অন্যদিকে গ্যাস নিগর্মন কমানোর বড় সহায়ক হতে পারে উচ্ছিষ্ট খাবারের পরিমাণ কমানো। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ৯০০ মিলিয়ন টন খাদ্যের উচ্ছিষ্ট জমা হয়। এই পরিমাণ কমানো হলে নির্গত গ্যাসের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যাবে। 

পরিবহন

ব্যক্তিগত পরিবহন বিশ্বের কার্বন গ্যাস নিগর্মনের এক বড় মাধ্যম। বর্তমানে পরিবহনের মাধ্যমে হিসেবে শুধু বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলের দেখা মেলে চারদিকে। এমনকি গ্রামের পা চালিত বাহন এখন যন্ত্রের কাছে হার মেনেছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে পরিবহন হিসেবে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল দখল করে আছে। এসকল বাহন থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। তবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিগর্মনের হার কমাতে হলে গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিত হতে হবে। অনেক সময় আমরা স্বল্প দুরুত্বে ভ্রমণের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করি। কিন্তু এই দুরুত্বে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। আগামীর পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে পরিবহনের ক্ষেত্রে আমাদের কৃচ্ছ্বসাধন করতে হবে। দুরের ভ্রমণের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে বড় আকারের পাবলিক বাস বা যানবাহনে ভ্রমণ করলে গ্যাস নিঃসরণের হার কমানো যায়। এককথায় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পরিহনের জন্য বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। তবে পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা কার্বন নিঃসরনের হার কমাতে পারি।

 গৃহস্থালি কাজ

আমাদের প্রতিদিনের গৃহস্থালির কাজের শেষ নেই। আমাদের অনেক কাজের সাথে কর্বান নিঃসরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিদিন পরিচিত এমন কিছু কাজের পরিবর্তন নিয়ে এলেই কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশে কক্ষ গরম রাখার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, যন্ত্র চালনার জন্য জ্বালানী বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয়। এসকল কক্ষ গরম রাখতে গিয়ে পরিবেশে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত জ্বালানীর শতকরা ৬৩ ভাগ কক্ষ গরম করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক বাড়ি গ্যাসে গরম রাখা হয়। যদি আমরা কার্বন নিঃসরণ কমাতে চায়, তবে অবশ্যই আমাদের কক্ষ গরম রাখার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। থার্মোটস্ট্যাটের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে তাপের বিল শতকরা ১০ ভাগ কমানো যায়, পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা যায়। পাশাপাশি কক্ষ গরম রাখার জন্য হিট পাম্প ব্যবহার করা যায়। এতে জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়াতে হয় না। হিট পাম্প বায়ু, পানি ও ভূ-স্তরের তাপকে শোষণ করে পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করে। এতে ইলেক্ট্রিক ব্যয় হয়, তবে সরাসরি জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়াতে হয় না। একইভাবে গরমের সময় শীতাতাপ যন্ত্র কম ব্যবহার করে প্রকৃতির বাতাসে সময় কাটালে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। একইসাথে বৈদ্যুতিক বিল কমানো যায়। 

গরম আবহাওয়ায় কক্ষ ঠান্ডা রাখতে বিভিন্ন কৃত্রিম যন্ত্রের ব্যবহার প্রতিনিয়ত পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ করছে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদেরকে এমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণ বৃ্দ্ধি পাবে। এসি থেকে প্রচুর পরিমাণে গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়, একইসাথে অধিক হারে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। আগামী বিশ্বকে নিরাপদ করতে আমাদেরকে ঘর ঠান্ডা রাখার বিকল্প টেকসই পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে ভবনের নঁকশার সাতে ঘরে বাতাস চলাচলের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনার নির্মাণ কৌশল দেখে এই বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারি। পাশাপাশি বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, দেয়ালে উপযোগী গাছ লাগিয়ে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ না করেও আমরা ঘর ঠান্ডা রাখতে পারি। অন্যদিকে ঠান্ডা পানি (গ্যাসে গরম না করে) দিয়ে কাপড় ধৌত করে তা স্বাভাবিক পরিবেশে (ড্রায়ার ব্যবহার না করে) শুকিয়ে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অবদান রাখতে পারি। দেখা গেছে এই পদ্ধতিতে কাপড় শুকালে বছরে প্রায় ০.৫ টন কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়।

অর্থব্যবস্থা

অর্থব্যবস্থা বিষয়টি হয়তো সরাসরি কার্বন ফুট প্রিন্ট হ্রাসের সাথে জড়িত না। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে এর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আপনার অর্থ আপনি কোথায় সঞ্চয় করছেন ,বিনিয়োগ করছেন তাদের কাজের সাথে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িত। কারণ বিশ্বের অসংখ্য ব্যাংক যারা সরাসরি জীবাশ্ম জ্বালানী উত্তোলন খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। এর সাথে জড়িতদের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। আবার অন্যদিকে অসংখ্য ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন কাজে বিনিয়োগ করে, এমনকি পরিবেশ কর্মীদের সহায়তা করে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। তাই আপনার জমাকৃত অর্থ, ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে।

ফ্যাশান

প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১০০ বিলিয়নের বেশি আইটেমের কাপড় উৎপন্ন হয়। বিষ্ময়কর বিষয় হলো, প্রস্তুত হওয়ার এক বছরের মধ্যে এর শতকরা ৬৫ ভাগ কাপড় ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ফ্যাশান সংশ্লিষ্ট খাত বৈশ্বিক হিসাবে শতকরা ৮-১০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। ফলে আমাদের কাপড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে টেকসই পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। প্রয়োজনের ‍তুলনায় বেশি কাপড় না কেনা, সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড় পরিধানে অভ্যস্ত হওয়ার প্রতি আমাদের আগ্রহী হতে হবে।

কাপড় পরিমিত মাত্রায় ধৌতকরণের মাধ্যমে সামান্য হলেও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও পানির সাথে পরিবাহিত ক্ষদ্রপ্লাস্টিক কণা রোধ করা যায়। তবে আসল বিষয় হলো আপনি আপনার কাপড় কিভাবে ব্যবহার করবেন তার দিকে নজর দিতে হবে। পরিধান শেষে কাপড় ভাগাড়ে ফেলে না দিয়ে যাদের সামর্থ্য কম তাদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া যায় বা সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানে বিক্রয় করা যায়।

এককথায় আমরা প্রতিনিয়ত জড়িত এমন কাজের সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ করা যা। নিজেকে সক্রিয় পরিবেশ কর্মী হিসেবে অত্মপ্রকাশ না করেও এমন সব অভ্যাসের মাধ্যমে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ রোধে ভূমিকা রাখা যায়। আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে আগামী বিশ্বের ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা যাবে এবং আগামী প্রজন্মকে একটি নিরাপদ ও টেকসহ পৃথিবী উপহার দিতে সক্ষম হবো।

সূত্র: বিবিসি

অনুবাদ: মোঃ রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞানকর্মী


 


 

No comments

Powered by Blogger.