-->

ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও ট্রাইকো-লিচেট কিভাবে তৈরী করবে?

ফসল চাষাবাদে জৈব সারের কোনো বিকল্প নেই। মাটিতে উর্বর রাখতে মাটিতে কমপক্ষে শতকরা ০৫ ভাগ জৈব উপাদান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের চাষের জমির মাটিতে জৈব সারের পরিমাণ শতকরা ১ ভাগেরও নিচে। প্রতিনিয়ত একই জমিতে একাধিক ফসল চাষাবাদ করা সেই তুলনায় জমিতে জৈব সার প্রয়োগ না করার ফলে জমিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষক চাষাবাদের ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে একদিকে ফসল অনিরাপদ হচ্ছে, অন্যদিকে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে। ফলে ফসলে বিভিন্ন রোগ পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে কৃষকদের মাঝে জৈব সারের ব্যবহারের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজ বাড়িতে জমানো গরুর গোবর ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষকরা এখন উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরীকৃত ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করছে।

তবে বর্তমানে ভার্মিকম্পোস্ট উতপাদনের পাশাপাশি ট্রাইকোকম্পোস্ট সার উতপাদন জনপ্রিয় হচ্ছে। উতপাদন প্রক্রিয়া ভার্মিকম্পোস্টের মতো হলেও, ট্রাইকোকম্পোস্ট উতপাদনের সময় ট্রাইকোকম্পোস্ট সার ও ট্রাইকো-লিচেট নামক তরল উপাদান পাওয়া যায়।

ট্রাইকো-কম্পোস্ট

ট্রাইকোকম্পোস্ট একটি উন্নতমানের জৈব সার যা গোবর, মুরগির বিষ্টা, কচুরিপানা বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক জৈব উপাদানের সাথে ট্রাইকোডার্মা (Trichoderma sp.) ছত্রাক মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয়। ট্রাইকোডার্মা (Trichoderma sp.) Hypocreaceae পরিবারের এক প্রকার উপকারী ছত্রাক । মাটি, গাছের শিকড়, পচা আবর্জনায় বাস করে।  এটি দ্রুত বর্ধনশীল এবং ক্ষতিকর ছত্রাক প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যখন ট্রাইকোডার্মা ছত্রাককে কম্পোস্টের সাথে মেশানো হয় তখন এটি এন্টিফাংগাল এজেন্ট হিসেবে উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাক জীবাণু নিধন করে।  

 

চিত্রঃ ট্রাইকো-কম্পোস্ট
ট্রাইকো-লিচেট কি? 

ট্রাইকো-লিচেট হলো ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরীর সময় হাউজ হতে নির্গত তরল পদার্থ যা ছত্রাকনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ট্রাইকো-লিচেটে সমপরিমাণ ট্রাইকোকম্পোস্ট অপেক্ষা অধিক মাত্রায় ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকের স্পোর ধারণ করে। ট্রাইকো-লিচেট গাছের পুষ্টি সহায়ক হিসেবে কাজ করে। সাধারণত এটি গাছে স্প্রে করা হয়। পাশাপাশি এটি পরবর্তীতে ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরীতে ব্যবহার করা হয়।  

ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও ট্রাইকো-লিচেট তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ

গোবর, মুরগীর বিষ্টা, সব্জির উচ্ছিষ্টাংশ, কচুরিপানা, কাঠের গুড়া, ভুট্টার গুড়া, নীম পাতা, চিটা গুড় ও ট্রাইকোডার্মা অণুবীজ ।

ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও ট্রাইকো-লিচেট প্রস্তুত প্রণালী

স্থান নির্বাচন: উচু স্থান যেখানে পানি জমবে না। নির্বাচিত স্থান সমতল হলে মাটি ফেলে ১ মিটার উঁচু করতে হবে।

১ম ধাপ: ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরীর জন্য সাধ্য অনুযায়ী চৌবাচ্চা বা হাউজ তৈরী করতে হবে। এমনকি স্যানিটারি/সিমেন্ট রিং ব্যবহার করেও ট্রাইকোকম্পোস্ট উতপাদন শুরু করা যায়। উদ্যোক্তার ইচ্ছে ও সামর্থ্য অনুযায়ী চৌবাচ্চা বা হাউজের আকার বা সিমেন্ট রিংয়ের সংখ্যা ভিন্ন হবে। তবে সাধারণত সঠিক নিয়মে ট্রাইকোকম্পোস্ট উতপাদনের লক্ষ্যে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ দুই ক্ষেত্রে (চৌবাচ্চা বা সিমেন্ট রিং) একটি আকারের পরামর্শ প্রদান করেন।

চৌবাচ্চা বা হাউজের ক্ষেত্রে: ৫ মিটার দৈর্ঘ্য, ৩.৫ মিটার প্রস্থ ও ৩.৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট পাকা

চিত্রঃ ট্রাইকো-কম্পোস্ট চৌবাচ্চা

চৌবাচ্চা বা হাউজ। তবে চৌবাচ্চা/হাউজের এক পার্শ্ব ছিদ্র রাখতে হবে এবং চৌবাচ্চার তল ছিদ্রে যে দিকে সেদিকে সামান্য ঢালু রাখতে হবে (অকেটটা নলকুপের গোড়ার চারপাশের পাকা পাটাতনের মতো যেন পানি একদিকের পাইপ বা নালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে)। এর মাধ্যমে ট্রাইকোকম্পোস্ট উতপাদনের সময় নিচে জমাকৃত তরল ট্রাইকোলিসেট খুব সহজে চৌবাচ্চার ছিদ্র দিয়ে বের হতে পারে এবং সংগ্রহ করা যায়। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা ও ছায়া দেওয়ার জন্য চৌবাচ্চার উপর চালা (টিনের বা পাটকাঠি-পলিথিন দিয়ে তৈরী চালা) দিতে হবে।  

স্যানিটারি বা সিমেন্ট রিংয়ের ক্ষেত্রে: ৭০ সে.মি. ব্যাস, ৪০ সে.মি. উচ্চতা ও ৫ সে.মি. পুরুত্ব বিশিষ্ট স্যানিটারি বা সিমেন্ট রিং সংগ্রহ করতে হবে। একটির উপর আরেকটি এভাবে তিনটি রিং সাজিয়ে
চিত্রঃ স্যানিটারি বা সিমেন্ট রিংয়ের হাউজ
সাধ্যমত একটি বা দুইটি বা তিনটি হাউজ বসাতে হবে। অর্থাত কেউ তিনটি রিং দিয়ে এক হাউজ বা ছয়টি রিং দিয়ে দুই হাউজ বানাতে পারেন। পরপর সাজানো রিং বসানোর পূর্বে মাটিতে পলিথিন বিছাতে হবে এবং এমনভাবে রাখতে হবে যেন পলিথিনের একপ্রান্ত ঢালু হয়। ঢালু অংশে পলিথিনের নিচে সামান্য গর্ত করতে হবে যেন রিংয়ে উতপাদিতে তরল ট্রাইকো-লিচেট গর্তে জমা হয় এবং সহজে সংগ্রহ করা যায়।


 

২য় ধাপ: রিং বা চৌবাচ্চার আয়তন বিবেচনা করে একটি পলিথিন শীটের উপর ২৮% গোবর, ৩৬ % মুরগীর বিষ্টা, ৫% সব্জির উচ্ছিষ্টাংশ, ২৫ % কচুরিপানা, ৩ % কাঠের গুড়া, ২ % ভুট্টার গুড়া ও ১% নিমপাতা একটির পর একটি বিছিয়ে দিতে হবে। অর্থাত ১০০ কেজি মিশ্রণ তৈরীর জন্য ২৮ কেজি

চিত্রঃ জৈব উপাদানের উপর চিটা গুড় ও ট্রাইকোডার্মার দ্রবণ ছিটিয়ে পা দিয়ে মাড়ানো

গোবর, ৩৬ কেজি মুরগীর বিষ্টা, ৫ কেজি সব্জির উচ্ছিষ্টাংশ, ২৫ কেজি কচুরিপানা, ৩ কেজি কাঠের গুড়া, ২ কেজি ভুট্টার গুড়া ও ১ কেজি নিমপাতা ব্যবহার করতে হবে। একটি বড় পাত্রের মধ্যে পানি, চিটাগুড় ও ট্রাইকোডার্মার দ্রবণ তৈরী করতে হবে। এই দ্রবণ পলিথিন শিটে বিছানো জৈব উপাদানের উপর ছিটাতে হবে যা জৈব উপাদানকে পচিয়ে ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরী করবে। ১ টন (১০০০ কিলোগ্রাম) জৈব উপাদান পচাতে ২ কেজি চিটাগুর ও ৫০০ মি.লি. ট্রাইকোডার্মা অণুবীজ ব্যবহৃত হয়। পলিথিন শিটে স্তরে স্তরে সাজানো জৈব উপাদানগুলো চিটা গুড়, ট্রাইকোডার্মা মিশ্রিত পানি ছিটিযে ভেজাতে হবে এবং পা দিয়ে ভালোভাবে মেশাতে হবে। জৈব উপাদানগুলো নরম কাদার মতো না হওয়া অবধি দ্রবণ যোগ করতে হবে এবং পা দিয়ে মাড়াতে হবে। 

 ৩য় ধাপ: নরম কাদার মতো মিশ্রণ এবার চৌবাচ্চা বা হাউজ বা সিমেন্টের রিংয়ে পঁচনের জন্য জাগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে চৌবাচ্চা/রিংয়ের উপরের (খোলা মুখের দিকে) ১৫ সে.মি. খালি রেখে নিচের অংশে মিশ্রণ দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। এরপর চৌবাচ্চা/রিং কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। জাগ দেওয়ার ৩-৪ দিন পর হাউজ থেকে পাওয়া তরল নির‌্যাস সংগ্রহ করে পুনরায় হাউজ বা রিংয়ের মধ্যে দিতে হবে। ৩ দিন পর হতে প্রাপ্ত তরল নির‌্যাস সংগ্রহ করতে হবে যা ট্রাইকো-লিচেট। মূলত উপরে উল্লেখিত রিংয়ের এর পাটাতনের প্রান্তে গর্ত বা চৌবাচ্চার প্রান্তে ছিদ্র দিয়ে ট্রাইকো-লিসেট বাইরে আসে। দেখা গেছে ১ জোড়া রিং হাউজে জাগ দেয়া ২১০ কেজি জৈব উপাদান থেকে ২.৫-৩ লিটার ট্রাইকো-লিচেট পাওয়া যায়।

৪র্থ ধাপ:

চিত্রঃ উৎপাদিত ট্রাইকো-কম্পোস্ট

২০-২৫ দিন পর রিং বা চৌবাচ্চার ভিতরে উপাদানসমূহ উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিতে হবে এবং ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সংগ্রহ উপযোগী হবে। হাউস থেকে ট্রাইকোকম্পোস্ট বের করে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে শুকাতে হবে। অতপর আর্দ্রতা ২০% এর নিচে নেমে এলে চালুনী (৪মিলিমিটার ছিদ্রযুক্ত) দিয়ে চেলে বস্তায় সংরক্ষণ করতে হবে। দেখা গেছে, ১ টি রিং  হাউজ থেকে ১০৫ কেজি পরিমাণ ট্রাইকো-কম্পোস্ট পাওয়া যায়। 

 

 

ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও ট্রাইকো-লিচেট প্রয়োগ পদ্ধতি ও মাত্রা

চিত্রঃ ফসলের জমিতে ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্রয়োগ

জমি তৈরীর শেষ চাষের সময় বা সব্জির বীজ বপন বা চারা রোপণের ৮-১০ দিন পূর্বে জমিতে ট্রাইকো-কম্পোস্ট ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে বেশি করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। এরপর জমিতে ‘জো’ এলে মাটি ঝুরঝুরা করে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হবে। হেক্টর প্রতি ট্রাইকো-কম্পোস্ট ব্যবহারের পরিমাণ ২.৫-৩ টন। তবে বাড়ন্ত অবস্থায় চাইলে গাছের গোড়ায় ট্রাইকোকম্পোস্ট প্রয়োগ করা যেতে পারে। অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজ অঙ্কুরোদগমের পর চারার বৃদ্ধিকালীন সময়ে ৭ দিন এবং ফসলের বাড়ন্ত অবস্থায় ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রতি লিটার পানিতে ২০মি.লি. ট্রাইকো-লিচেট মিশিয়ে স্প্রে করুন। 

অধিক ফলনের জন্য কয়েকটি ফসলে প্রয়োগমাত্রা (প্রতি শতকে) 

আলুর জন্য = ৭ কেজি, সবজির জন্য = ৫ কেজি, ভূট্টার জন্য = ৮ কেজি, ধানের জন্য = ৭ কেজি

ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও ট্রাইকো-লিচেটের উপকারিতা 

১। ট্রাইকো-কম্পোস্ট মাটির জন্য উপকারী সুষম সার যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

২। ট্রাইকোকম্পোস্ট মাটির গঠন উন্নত করে, মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, মাটির পিএইচ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। 

৩। ট্রাইকো-কম্পোস্ট ক্ষতিকর ছত্রাক যেমন এর বিরুদ্ধে কাজ করে। ফলে এসকল ছত্রাক ফসলকে আক্রমণ করতে পারে না।

৪। ট্রাইকো-কম্পোস্টের মধ্যে মুরগির বিষ্টা থাকায় ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট ও নেমাটোডের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করে।

৫। ট্রাইকো-কম্পোস্ট উদ্ভিদের দৈহিক ‍বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।

৬। ট্রাইকো-লিচেট শক্তিশালী এন্টি-ফাঙ্গাল (ক্ষতিকর ছত্রাক প্রতিরোধী), ফলে নেতিয়ে পড়া, পিথিয়াম রট (পচন), ফিউজুরিয়াম উইল্ট, ঢলে পড়া, শিকড় গিট রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। এছাড়াও এটি ‍উদ্ভিদকে সতেজ রাখার পাশাপাশি ফুল, ফলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। 

সূত্রঃ এনএটিপি (ডিএই অঙ্গ) লিফলেট, ইকোকমিউনিটি ও গবেষণা প্রবন্ধ।  

লেখক: রফিকুল ইসলাম, কৃষিবিদ ও বিজ্ঞান লেখক 

 


 


 

No comments

Powered by Blogger.