-->

ইলেক্ট্রনিক মাটির যুগে আগামীর কৃষি

 


মাটিতে বীজ বপন করা হয়, উপযুক্ত পরিবেশে সেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে। এরপর কৃষকের পরিচর‌্যা, সার, পানির প্রভাবে ধীরে ধীরে গাছ বেড়ে উঠে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেই গাছ থেকে ফলন পাওয়া যায়। কৃষির ক্ষেত্রে ফসল চাষাবাদের এটি অতি পরিচিত ঘটনা। এককথায় ফসল চাষাবাদে মাটি থাকবে এটি অতি সাধারণ ভাবনা। তবে সময়ের সাথে মানুষের প্রয়োজনে, বিজ্ঞানের গবেষণায় ফসল চাষাবাদে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে মাটি বাদে ফসল আবাদ করা সম্ভব হয়েছে। তবে সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী গবেষণা হাইড্রোফনিক পদ্ধতিকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। সুইডেনের লিংকোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য একটি তড়িৎ পরিবাহী বৃদ্ধি মিডিয়াম (electrically conductive growing medium) উদ্ভাবন করেছেন যা হাইড্রোফনিক পদ্ধতির অগ্রগতি ঘটিয়েছে এবং কৃষিকে নতুন যুগে প্রবেশের সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। তড়িৎ পরিবাহী বৃদ্ধি মিডিয়ামের নাম দেওয়া হয়েছে ইলেক্ট্রনিক সয়েল বা ই-মাটি।

মাটি বাদে চাষাবাদের এক অভিনব পদ্ধতি হলো হাইড্রোফোনিক। সাধারণত এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য মাটির প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যে এই পদ্ধতিতে সবজি, লেটুস চাষাবাদে বেশ সফলতা দেখা গেছে। পানিতে আবাদ করা এই সকল ফসলে বিশেষ পদ্ধতিতে পুষ্টি সরবরাহ করা হয় এবং এদের শিকড় বা মূল কোনো নির্দিষ্ট দ্রব্যের স্তরের সাথে যুক্ত থাকে। এটি একটি আবদ্ধ পদ্ধতি এবং এর মাধ্যমে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং প্রতিটি গাছ সমানতালে পুষ্টি লাভ করে। সাধারণত এতদিন গতানুগতিক হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে ‍সবজি, লেটুস আবাদ করা হয়েছে। তবে এই পদ্ধতিতে দানাদার ফসল চাষ করা হয় নি। তবে নতুন এক পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দানাদার জাতীয় ফসল আবাদের সম্ভাবনা দেখা গেছে। হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা প্রবাহিত করে বিজ্ঞানীরা বার্লি আবাদ করতে সক্ষম হয়েছেন। লিংকোপিং ইউনিভার্সিটির জৈব ইলেকট্রনিকস ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী এলেনি স্ট্যাভরিনিডোর উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি আগামীর কৃষিতে কিভাবে কাজ করবে তা জানার চেষ্টায় আমাদের আয়োজন।

 

ইলেক্ট্রনিক সয়েল বা ই-মাটি কী?


এলেনি স্ট্যাভরিনিডোরের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, হাইড্রোফনিক পরিবেশে ই-মাটি হলো কম শক্তিসম্পন্ন জৈব-ইলেক্ট্রনিক বৃদ্ধি মাধ্যম যা গাছের মূলে তড়িৎ উদ্দীপনা প্রদান করে এবং গাছের বৃদ্ধি উপযোগী পরিবেশ তৈরী করে। এই অভিনব উপাদান সেলুলোজ ও PEDOT নামক পরিবাহী পলিমার দিয়ে তৈরী। ফলে এটি পরিবেশ বান্ধব। ই-মাটির জন্য কম শক্তি প্রয়োজন হয়। ফলে এটি সম্পদের অপচয় থেকে রক্ষা করে। এটি আয়নিক ইলেক্ট্রনিক কন্ডাক্টর মিশ্রত জৈব উপাদান। 

 

ই-মাটি কিভাবে কাজ করে?


প্রকাশিত গবেষণায় ই-মাটি উল্লেখযোগ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এলেনি স্ট্যাভরিনিডোরের গবেষণায় দেখা গেছে, বার্লি বীজে ১৫ দিন তড়িৎ উদ্দীপনা প্রদান করলে তার অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৫০% বেড়ে যায়। এই গবেষণা ফলাফলের মাধ্যমে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে বহুমুখী ফসল চাষাবাদের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে কোনো ফসল চাষাবাদের পানি, পুষ্টি উপাদান এবং একটি মাধ্যমের (যার সাথে মূল যুক্ত থাকে) প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতিতে পানি পুনঃপ্রবর্তিত হয় যার ফলে প্রতিটি গাছ তার প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টি লাভ করে। ফলে কম পানির প্রয়োজন হয় এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয় যা গতানুগতিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না।

জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে বা চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার অভাব মেটাতে বিশাল বিশাল টাওয়ারে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে উল্লম্ব চাষাবাদ করা যায়। বর্তমানে এইভাবে জন্মানো ফসলের মধ্যে লেটুস, ভেষজ এবং কিছু শাকসবজি রয়েছে। সাধারণত হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে দানাদার জাতীয় ফসল আবাদ সম্ভব হয় নি। লিংকোপিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে বার্লি আবাদ করা যায় এবং তড়িৎ উদ্দীপনার মাধ্যমে এর বৃদ্ধির হার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 


এলেনি স্ট্যাভরিনিডোর বলেন, “এই পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কম পরিমাণ গ্রহণ করেও গাছের চারার অধিক হারে বৃদ্ধি ঘটে। যদিও কিভাবে এটি ঘটে এবং কোন জৈব পদ্ধতি এর সাথে জড়িত সেই সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। আমরা বুঝতে পারছি তড়িৎ উদ্দীপনা প্রদান করলে গাছের চারা খুব দ্রুত বেগে নাইট্রোজেন প্রক্রিয়াজাত করে, তবে কিভাবে এই তড়িৎ উদ্দীপনা এই পদ্ধতির উপর ক্রিয়া করে সে বিষয় স্পষ্ট নয়”। 

 

ই-মাটি ব্যবহারে কী সুবিধা হবে?

এটি সত্য যে মাটি বিহীন হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রতিনিয়ত বিস্তার লাভ করছে। ই-মাটি যোগ হওয়ায় এই পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারিত হবে। মাটি ছাড়া হাইড্রোফনিক এবং কম শক্তি গ্রাহক ও নিরাপদ ই-মাটির যুগলবন্দি আগামী বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় একটি টেকসই কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে। বর্তমান বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে এলেনি স্ট্যাভরিনিডোর বলেন, ‘শুধুমাত্র আমাদের বিদ্যমান চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে আগামী বিশ্বের খাদ্য যোগান দিতে পারবো না। তবে এটা মাটিবিহীন শহর বা নগরে আমরা নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে হাইড্রোফনিক্স চাষাবাদের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করতে পারবো।’ তিনি বিশ্বাস করেন তার এই গবেষণা আগামী দিনের হাইড্রোফনিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় বিজ্ঞানীদের সহায়তা করবে। তিনি আরোও উল্লেখ করেন যে, ‘আমরা বলছি না হাইড্রোফনিক খাদ্য সংকটের সমাধান করে দিবে, বরং এই পদ্ধতির মাধ্যমে কম আবাদযোগ্য ও বিরূপ আবহাওয়ায় কিছুটা হলেও খাদ্য যোগান দেওয়ার জন্য সহায়ক হবে’।

সূত্র: হিন্দু্স্থান টাইমস, pnas.org, eurekalert.org, indianexpress.com, earth.com, phys.org, e-soil.net

সম্পাদনা: রফিকুল ইসলাম, কৃষিবিদ ও বিজ্ঞান কর্মী

No comments

Powered by Blogger.