-->

বইঃ গাছেরা কেমনে কথা কয়? (২য় পর্ব)

 

গাছের দর্শন অনুভূতি নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে বিজ্ঞান ডারউইন একটি যুগান্তকারী গবেষণা পরিচালনা করেছেন। গবেষণাটি গাছের কোন প্রান্ত আলো দেখতে পায় তা নির্ণয়ে একটি যুগান্তকারী

গবেষণা যা পরবর্তী গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছিল।

বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের গবেষণা

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন On the Origin of Species  বইটি রচনা করেন। পাশাপাশি জীববিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি শাখায় তার গবেষণা রয়েছে। তবে বইটি প্রকাশের পর থেকে পরবর্তী বিশ বছরের তার ধারাবাহিক গবেষণা আজকের উদ্ভিদ গবেষণায় এতটা প্রভাব ফেলবে তা অনেকের অজানা ছিল।

গাছের বৃদ্ধির উপর আলোর প্রভাব ডারউইনকে বিমোহিত করেছিল। একইভাবে তার পুত্র ফ্রান্সিস এই বিষয়টির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ডারউইন তার সর্বশেষ বই The Power of Movement in Plants এ উল্লেখ করেছেন, “প্রকৃতিতে খুব কম সংখ্যক উদ্ভিদ আছে যাদের কোনো একটি অংশ আলোর দিকে বেঁকে যায় না।” আধুনিক ইংরেজিতে এর অর্থ দাঁড়ায় “প্রায় সকল উদ্ভিদ আলোর দিকে বেঁকে যায়”। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে জন্মানো গাছের ক্ষেত্রে এমনটি দেখতে পায়। ঘরের জানালা দিয়ে আগত সূর্য রশ্মির দিকে গাছ বেঁকে যায়। গাছের এই ধর্ম ফটোট্রপিজম (phototropism) নামে পরিচিত। জুলিয়াস ভন স্যাকস ছিলেন ডারউইনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী। ১৮৬৪ সালে তিনি উদ্ভাবন করেন যে, নীল আলো হলো প্রাথমিক বর্ণ যা গাছের ফটোট্রপিজম ধর্মকে প্রণোদিত করে। তবে, কিভাবে বা গাছের কোন অংশ কোনো একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে আসা আলো দেখতে পায় সে সম্পর্কে তখন কেউ জানতো না।


ডারউইন ও তার পুত্র একটি সরল পরীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তারা দেখান যে, আলোর দিকে গাছের বেঁকে যাওয়ার সাথে সালোকসংশ্লেষণ জড়িত নয়। সালোকসংশ্লেষণ এমন একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে গাছ আলোক শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করে। বরং উদ্ভিদ তার নিজ দেহের কিছু সহজাত সংবেদনশীল গুণাবলীর কারণে আলোর দিকে বেঁকে যায়। গবেষণার অংশ হিসেবে ডারউইনেরা একটি পাত্রে ক্যানারি ঘাস রোপন করেন এবং কয়েকদিন অন্ধকার পরিবেশে রেখে দেন। এরপর ঘাসের পাত্র থেকে ১২ ফুট দুরে একটি গ্যাস ল্যাম্প স্থাপন করেন। ল্যাম্পের আলো কমিয়ে এমনভাবে মৃদু আলোর (dim light) পরিবেশ তৈরি করা হয় যেন তারা পাত্রের ঘাস দেখতে না পান, এমনকি কাগজে রাখা পেন্সিলও স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে অবাক বিষয় হলো, মাত্র তিন ঘন্টা পর পাত্রের ঘাস মৃদু আলোর (dim light) দিকে বেঁকে যায়। মজার বিষয় হলো এই বক্রতা সবসময় ঘাসের একটি নির্দিষ্ট অংশে সংঘটিত হয়। প্রতিবার ঘাসের অগ্রভাগের এক ইঞ্চি বা তার কিছু বেশি নিচের অংশ মৃদু আলোর দিকে বেঁকে যায়।


চিত্র: ক্যানারি ঘাস (Phalaris canariensis)

এই পরীক্ষা মাধ্যমে তাদের মনে নতুন একটি প্রশ্নের জন্ম নেয়। গাছের কোন অংশ আলো দেখতে পায়? তাদের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ তৈরি হয়। প্রশ্নের উত্তর জানতে ডারউইনের পরিচালিত গবেষণা পরবর্তিতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ক্ল্যাসিক্যাল গবেষণা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গবেষণার অংশ হিসেবে তারা একটি অনুমান (hypothesis) দাড় করান  এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তা যাচাই করেন। তাদের অনুমান ছিল- ‘গাছের চোখ  (যে অংশ আলো দেখতে পায়, পরীক্ষণে ডারউইন চোখ হিসেবে উল্লেখ করেন) চারার ডগা বা অগ্রভাগে থাকে এবং চারার যে অংশ বেঁকে যায় সেখানে থাকে না।’ এই অনুমান যাচাইয়ের জন্য তারা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন চারার ফটোট্রপিজম পরীক্ষা করেন। নিচের চিত্রে তাদের গবেষণা প্রদর্শিত হয়েছে।

চিত্র:  ডারউইনের পরীক্ষা

a) চারাটিতে কোনো বাহ্যিক প্রভাব সৃষ্টি করা হয় নি অর্থাৎ চারাটি আনট্রিটেড (untreated) অবস্থায় আছে এবং পরীক্ষণে চারাটিতে স্বাভাবিক ফটোট্রপিজম সংঘটিত হওয়ার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

b) দ্বিতীয় চারাটির অগ্রভাগ কেঁটে ফেলা হয়েছে।

c) তৃতীয় চারাটির অগ্রভাগ আলো প্রতিরোধী ক্যাপ (Lightproof cap) দিয়ে আবৃত করা হয়েছে।

d) চতুর্থ চারাটির অগ্রভাগে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দেওয়া হয়েছে।

e) পঞ্চম চারাগাছের মধ্যভাগ থেকে নিচের অংশ আলো প্রতিরোধী ক্যাপ (Lightproof cap) দিয়ে আবৃত করা হয়েছে।  

তারা পূর্বে পরিচালিত পরীক্ষার ন্যায় এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। স্বাভাবিকভাবে প্রথম চারাটি (a) আলোর দিকে বেঁকে যায়। একইভাবে কান্ডের মধ্যভাগ থেকে নিচের অংশ আলো প্রতিরোধী ক্যাপে আবৃত চারা (e) আলোর দিকে বেঁকে যায়। যদি তারা চারার অগ্রভাগ বিমুক্ত করে বা আলো প্রতিরোধী ক্যাপ দিয়ে আবৃত করে তাহলে চারা অন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ আলোর দিকে বেঁকে যায় না। এরপর তারা আলোর প্রতি চতুর্থ চারার আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায় চতুর্থ চারার শীর্ষভাগে ক্যাপ দিয়ে আবৃত থাকলেও চারাটি আলোর দিকে বেঁকে গেছে। অন্য চারায় ব্যবহৃত ক্যাপের সাথে পার্থক্য হলো, চতুর্থ চারাটির অগ্রভাগের ক্যাপটি স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি যার মধ্য দিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে। ডারউইন অনুধাবন করেন যে, কাঁচের মধ্য দিয়ে আলো প্রবেশ করে চারার অগ্রভাগে আপতিত হয়। ১৮৮০ সালে প্রকাশিত এই সরল পরীক্ষার মাধ্যমে ডারউইন ও তার পুত্র প্রমাণ করেছেন যে, ‘গাছের অঙ্কুরের (shoot) শীর্ষভাগে আলো আপতিত হওয়ার ফলে ফটোট্রপিজম সংঘটিত হয়। অঙ্কুরের শীর্ষভাগ আলো দেখতে পায় এবং কান্ডের মধ্যভাগে প্রেরণ করে আলোর দিকে গাছকে বাঁকার নির্দেশনা দেয়। এর মাধ্যমে ডারউইন সফলভাবে গাছের দর্শন প্রান্ত ব্যাখ্যা করেন। 

সূত্রঃ ‘গাছেরা কেমনে কথা কয়?’ ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিতব্য বই। What a plant knows বইয়ের আলোকে রফিকুল ইসলামের রচনা।

No comments

Powered by Blogger.